অমর একুশে আজ-
মাতৃভাষার জন্য জ্বলে উঠেছিল বর্ণমালা
‘অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে সেদিন বর্ণমালা
সেই থেকে শুরু, সেই থেকে শুরু দিনবদলের পালা।’
গীতি কবির ভাষায় বাঙালি জাতির দিন বদলের পালা শুরু হয়েছিল যেদিন, বাঙালির মননে অনন্য মহিমায় ভাস্বর চির স্মরণীয় সেই অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আজ।
সরকারি ছুটির দিন। অর্ধনমিত রাখা হবে জাতীয় পতাকা। একই সঙ্গে সর্বত্র ওড়ানো হবে শোকের কালো পতাকা। সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও বেতারে ভাষা দিবসের বিশেষ ক্রোড়পত্র ও অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হচ্ছে।
মাতৃভাষা প্রেমী বাঙালির ইতিহাসের পাতায় রক্ত পলাশ হয়ে ফোটা সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউর, আউয়াল, অহি উল্লাহর রক্তরঞ্জিত রাষ্ট্রভাষা অধিকারের পালা শুরু হয়েছিল এদিন
বাঙালির পাশাপাশি আজ বিশ্ববাসীও পালন করছে “মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস”। বিশ্বের নানা প্রান্তে আজ উচ্চারিত হবে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’।
নানা আয়োজনে আজ সারা দেশে পালিত হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারি। সকালের আলো ফোটার পর প্রভাত ফেরি। নিজ নিজ এলাকার শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়ার পাশাপাশি নিজেরা সাময়িক শহীদ মিনার বানিয়েও দিনটিকে স্মরণ করার রেওয়াজ আছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন একুশের রক্তাক্ত স্মৃতি-বিজড়িত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে রাষ্ট্রীয় আয়োজনে একুশের অনুষ্ঠানমালার সূচনা হয় রাত ১২টা এক মিনিটে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের পর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পরিবারের পক্ষ হতে মহাপরিচালক মহোদয় একুশের প্রথম প্রহরে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। এর পর সর্বস্তরের মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ‘একুশ মানে মাথানত না করা’ চিরকালের এ স্লোগান আর বুকে শোকের প্রতীক কালো ব্যাজ ধারণ করে, খালি পায়ে আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই শামিল হবেন শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য।
ফিরে দেখা সেই সব দিন:
১৯৪৭ সালের ব্রিটিশ-ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে ভাষা-বিরোধ জন্ম নেয়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী রাষ্ট্রের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে অস্বীকার করে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করে। এর প্রতিবাদে সোচ্চার হন বাংলার বুদ্ধিজীবীরা।
১৯৪৮ সালেই গড়ে ওঠে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ওই বছরের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দম্ভভরে উচ্চারণ করেন, ‘উর্দু, কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা অন্য কোনো ভাষা নয়।’ প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বাংলা জুড়ে। শুরু হয় ভাষার জন্য বাঙালির প্রাণপণ সংগ্রাম।
১৯৫২ সালে আন্দোলন তীব্রতর হয়ে উঠলে শাসক গোষ্ঠী নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আম তলার সভা থেকে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মিছিল বের করে দশ জন দশ জন করে। পুলিশ বাধা দিলে বাধে সংঘর্ষ। এক পর্যায়ে গুলি বর্ষণ করে পুলিশ। শহীদ হন আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন আহমদ ও আবদুল জব্বার। ছাত্র মিছিলে গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারিও ঘটে গুলি বর্ষণের ঘটনা। এদিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সফিউর রহমান, রিকশা চালক আবদুল আউয়াল, অহিউল্লাহসহ কয়েকজন অজ্ঞাত মানুষ। আর ৭ এপ্রিল মারা যান আহত আবদুস সালাম।
এক পর্যায়ে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের কাছে নতিস্বীকার করে পাকিস্তানি সরকার। বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় তারা। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্ত ফ্রন্ট সরকার গঠন করলে একুশে ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক দিবস পালনের রীতি চালু হয়। মূলত একুশের পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রাম। ফলে একাত্তরে এসে জন্ম নেয় স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
মাতৃভাষার মর্যাদায় বুকের রক্ত ঢেলে বাঙালি জাতি যে ইতিহাস রচনা করেছিল, সেই একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা-ইউনেসকো তাদের ত্রিশতম সম্মেলনে ২৮টি দেশের সমর্থনে এই ঐতিহাসিক ঘোষণা দেয়। ২০০০ সাল ১৮৮টি দেশে একযোগে এ দিবসটি পালিত হচ্ছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য একুশে ফেব্রুয়ারি এখন সার্বজনীন উৎসবের দিন।
কর্মসূচিঃ শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। এ ছাড়া দিবসটি স্মরণে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠন বিশেষ কর্মসূচি নিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে এবং শোকের প্রতীক কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, আজিমপুরে শহীদদের কবর জিয়ারত, দোয়া মাহফিল, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
শহীদ মিনারমুখী সড়ক থাকবে নিয়ন্ত্রিতঃ একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে গড়ে তোলা হয়েছে নিরাপত্তাবলয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও আজিমপুর কবরস্থান অভিমুখী সড়কে আজ যান চলাচল নিয়ন্ত্রিত থাকবে বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
আসছে একুশে ফেব্রুয়ারী তো দোর গোড়ায়, আমরা কি একবার নিজের বাংলা ভাষাটা চর্চার জন্য মনস্থির করতে পারি? ছোট দেশ, এর যদি ভাষাই বদলে যায়, তবে জাতীয়তা টেকানো নিয়ে সংশয় বেড়ে যাবে না?
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস